কেন করি ছাত্রসেনা ?? — ওয়াহিদুল আলম সোহেল
কেন করি ছাত্রসেনা
————————-
সৃষ্টিকর্তা যত ধরণের অনুভূতি বুঝবার ক্ষমতা তাঁর সৃষ্ট জীবজগৎকে দান করেছেন তার ভেতর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ অনুভূতি হলো ভালবাসার অনুভূতি। এই অনুভূতি কেবল সৃষ্টির সেরা জীব মানুষই বুঝতে পারে তা নয়, মানুষ ব্যতীত অন্য সকল প্রাণীরও অাছে ভালবাসার
অনুভূতি। অাপনি একটি কাকের বাচ্চাকে হত্যা করুণ। দেখবেন রাজ্যের কাক এসে সেই মৃত কাকটিকে ঘিরে শোকসভায় শামিল হবে। কাকেদের চিৎকার চেঁচামিচি অার অার্তনাদের করুণ অাওয়াজে ভারি হয়ে উঠবে অাকাশ। যেন বা একটি মৃত কাকছানার বেদনার্ত শেষকৃত্য। একটি মুরগীছানাকে অাঘাত করবার অভিপ্রায়ে এগিয়ে যান। দেখবেন ছানাটির মা অাপনার দিকে তেড়ে অাসবে। এবং তার নিজস্ব ক্ষমতা দিয়ে ছানাটিকে অাপনার অাঘাত থেকে রক্ষা করে অন্য সকল ছানাকে তার পাখার অাঁচলের ভেতর এমনভাবে অাবৃত করে রাখবে যেন অার কেউ অাঘাত করতে না পারে। এর নাম ভালবাসা। ভালবাসার অনুভূতি সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে পরম এবং অাশ্চর্য দান।
কারোর প্রতি ভালবাসার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উদাহরণ সৃষ্টিকর্তা নিজেই। কুল কায়েনাত সৃষ্টির বহু অাগে যখন তিনি ব্যতীত কিছুই ছিল না তখন হঠাৎ তাঁর ভেতর ভালবাসার অনুভূতি জেগে উঠলো। সেই ভালবাসার মায়ায় পড়ে তিনি স্বীয় নূর থেকে একটি নূর সৃষ্টি করলেন। যে নূর থেকে তিনি তাঁর সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি, মানব জগতের শ্রেষ্ঠতম মহামানবকে নূরের অাকৃতি দিলেন। এবং জগৎ সৃষ্টির বহুকাল পরে তিনি সেই মহামানবকে দুনিয়ায় পাঠালেন।
ধ্বংসশীল এই জগৎ সৃষ্টিকর্তা কেবল সেই মহামানবকে ভালবেসে, তাঁর প্রেমে পড়ে সৃষ্টি করেছেন। সে কারণেই তিনি তাঁর সৃষ্ট মহামানবকে একটি কোমল হৃদয়ের অধিকারী করেছেন। অার সে হৃদয়ে দিয়েছেন অফুরন্ত ভালবাসা। সৃষ্টিকর্তা-প্রদত্ত ভালবাসাময় কোমল হৃদয়ের অধিকারী মহামানব ভালবাসলেন পুরো সৃষ্টিজগতকে। সৃষ্টিজগৎ ভালবাসলো তাঁকে। এই ভালবাসার সূত্র ধরে অামরা, মনুষ্যপ্রাণ ভালবাসলাম তাঁকে। তাঁকে ভালবেসেই অামরা যাবতীয় ইহজাগতিক সৎ কর্মকান্ড পরিচালনা করে অাসছিলাম। কিন্তু তা কেবল পার্থিব জগতের স্বার্থোদ্ধার করবার প্রয়োজনে দুষ্ট বলে অামরা, মহামানবের নগণ্য কিছু প্রেমিক, অামরা সকলে, সৃষ্টিকর্তা-সৃষ্ট সেই অকৃত্রিম ভালবাসার সূত্র ধরে, তাঁকে, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম প্রাণটিকে, সেই মহামানবটিকে হৃদয় থেকে, পরাণের গহীন ভেতর থেকে ভালবেসে, ভালবাসার শ্রেষ্ঠ বিরল পার্থিব দৃষ্টান্ত স্থাপন করবার মানসে প্রতিষ্ঠা করেছি একটি উম্মাহ্। ভালবেসে তার নাম দিয়েছি “ইসলামী ছাত্রসেনা।”
বলবার অপেক্ষা রাখে না; ইতিপূর্বে বলা হয়ে গেছে কথাটি; তবু, কথার গভীরে প্রবেশ করাবার জন্যে, সরলরকমে কথাটিকে উপস্থাপন করবার প্রয়োজনবোধ করছি। ভালবাসা অার প্রেমের যে ফল্গুধারা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা থেকে বেয়ে অামাদের ভেতর ঢুকেছে, অামরা তারই প্রবহমান স্রোতধারায় হৃদয় ভাসিয়েছি। অামাদের হাতে ধরা অাছে সৃষ্টিকর্তা-সৃষ্ট সেই প্রেমের রজ্জু। যার খোদায়ী বিশেষণ হলো “নবীপ্রেম”। অার মানুষের মাঝে নবীপ্রেম জাগাবার এবং তা সমাজে প্রতিষ্ঠা করবার সংগঠিত নাম “ইসলামী ছাত্রসেনা”।
নবীপ্রেম বুকের ভেতর ধারণ করে “ইসলামী ছাত্রসেনা” প্রতিষ্ঠা করবার কারণে অামরা কোরঅান-ঘোষিত “উসওয়াতুন হাসানা” অথবা নবীর সুমহান অাদর্শকে চলার পথের পাথেয় করেছি। অাদর্শটিকে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের পলিমাটির উপর বাস্তবিক রূপ দেবার প্রত্যয়ে অামরা একটি প্রেমসৃষ্ট বাণীকে কায়মনোবাক্যে বিশ্বাস করেছি–
“কোরঅান-সুন্নাহভিত্তিক ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠাই অামাদের লক্ষ্য।”
বস্তুত: এ স্লোগানের ভেতরেই অামাদের ঘোষিত অাদর্শিক অান্দোলনের মূল দর্শনটি নিহিত। বাংলাদেশের অন্য ছাত্রসংগঠনগুলির সাথে ঠিক এই দর্শনের জায়গাটিতেই অামাদের বিস্তর ফারাক। তবে সেটি অালোচনা করবার জন্যে ভিন্ন একটি নিবন্ধ রচনার প্রয়োজনবোধ করছি। কিন্তু অামাদের অাজকের জিজ্ঞাসা, কেন করি ছাত্রসেনা? একেবারে ক্ষুদ্র পরিসরে সেটিই অামরা শুনবো।
ক্ষুদ্র পরিসরে বলবার কারণ দু’টি। একটি, পাঠকের সময় বিবেচনায় স্বল্প কথায় মূলকথাটি তুলে ধরা। অন্যটি, উপরের অালোচনাতেই মূলকথাটি বলবার প্রয়াস পেয়েছি। বলেছি নবীপ্রেমই অামাদের মূল দর্শন।যে প্রেমটি স্বয়ং প্রভুর মহান সত্ত্বার ভেতর থেকে অামাদের ভেতর এসেছে। তার সাথে সমাজে কোরঅান-সুন্নাহ্’র অাইন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের কথাটিও লিখেছি। এই দ্বৈত বক্তব্য সামনে রাখলে সমঝদারগণ অামাদের দর্শনচিন্তার মূল বার্তাটি পাবেন বলে বিশ্বাস করি।
একটি কথার সাথে কেউই দ্বিমত পোষন করবেন না যে, সারা দুনিয়ার মানুষ এখন একটি পরিবর্তন চায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরিবর্তনের কথাটি অারো ধ্রুবসত্য। অামরা এই পঁচনশীল সমাজটির ইতিবাচক পরিবর্তন চাই। অামরা সকল নেতিবাচক সামাজিক প্রথাসমূহের সমাধি রচনা করতে চাই। বর্তমান সমাজে বসবাসরত সকলেই এসব পরিবর্তনের পক্ষে সুর মেলাবে। কিন্তু সকলেই এই মহৎ কর্মটিতে প্রায়োগিক অর্থে শামিল হবে এমনটি নয়। অথচ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ হয়ে গেলে এর সুফল সকলেই ভোগ করবে। তাই কাউকে না কাউকে পরিবর্তনের অাহ্বানটি করতে হয়। অালোটি জ্বালাতে হয়।
সামাজিক পরিবর্তনের বিষয়টি সামনে রাখলেই এর পুরো ব্যাপারটি অামাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। এর মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক পরিবর্তন, অর্থনৈতিক পরিবর্তন, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, বিচার ব্যবস্থার পরিবর্তনগুলি সম্মুখে চলে অাসে। অামরা চাই সমাজটি একটি সুগঠিত অাইনের উপর দাঁড়াবে। সমাজের মানুষগুলি হবে মানসিকভাবে পরিপক্ক। পারষ্পরিক সম্পর্কগুলি হবে প্রেমময়। প্রেম যেখানে অস্তিত্বশীল, দ্বন্দ্ব-সংঘাত সে জায়গায় ধ্বংসশীল। সৎ লোকেরা সমাজের কর্তাব্যক্তির অাসনে বসবেন। তাঁরা মানবতার কথা বলবেন, মানুষের অধিকারের কথা বলবেন। তাঁরা বিচার করবেন ইনসাফ অার সততার সাথে। ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজের গুণগত পরিবর্তন ঘটবে। অামাদের ছেলে সন্তানগুলি বিপথে যাবে না। অামাদের কন্যা সন্তানগুলির নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। একা ব্যক্তির পক্ষে এসব কাজ অাঞ্জাম দেয়া সম্ভবপর নয়। ব্যক্তি নিজের নৈতিক পরিবর্তন সাধন করতে পারবে কেবল। কিন্তু নৈতিকভাবে সমাজের সামষ্টিক পরিবর্তন ঘটানোর জন্যে চাই সংঘবদ্ধ প্রয়াস। নতুবা পঁচনের যে অাগুন সমাজের শরীরে লেগেছে তার অাঁচ থেকে ব্যক্তি মানুষ নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না।
বর্ণিত পঁচনশীল সমাজের অাদর্শিক পরিবর্তন ঘটাবার জন্যে সংঘবদ্ধ কাফেলার নাম “ইসলামী ছাত্রসেনা।”
ইসলামী ছাত্রসেনা প্রতিষ্ঠার অাটত্রিশ বছরের ইতিহাস একটি বীরত্ব, সংগ্রাম অার প্রেমময় অাখ্যান। রক্তাক্ত সাদা পাতায় সে অাখ্যান সোনালী অক্ষরে ভাস্বর। বলবার কথা, বলতে সাহস লাগে; কথাটি বলবার অধিকার অামরা তিলে তিলে অর্জন করেছি; বলতে অামাদের বুক এতটুকু কাঁপবে না; পড়বে না চোখের ভীতু পলকও; বরং একই সাথে ঈমানী ও প্রেমময় কণ্ঠে অামরা বলতে পারবো কথাটি– অাটত্রিশ বছরের দৃপ্ত পথচলায় ইসলামী ছাত্রসেনা’র পবিত্র শরীরে কালিমার লেশমাত্র অাঁচও নেই। নেই। পিতার প্রশস্ত বুকের মতন সফেদ-শুভ্র সেই পবিত্র জমিন।
এমন কথা বলবার পরে, বলবার সময় অামাদের সেই সাহসী খোলা চোখ এক্ষণ বন্ধ হয়ে অাসে। অামরা সহসা চোখ বন্ধ করি। কসম সেই মহান সত্ত্বার, যাঁর সৃষ্ট প্রেমের ধারা অামাদের হৃদয়ে চির বহমান, চোখ বন্ধ করবার সাথে সাথে চোখের সামনে অামরা একটি পবিত্র সুদৃশ্য গম্বুজ দেখতে পাই। যার গায়ে মহান প্রভু জড়িয়ে দিয়েছেন একটি প্রেমময় সবুজ চাদর।
ভালবাসি ইসলামী ছাত্রসেনা।
লেখকঃ ওয়াহিদুল আলম সোহেল